গত জুলাই মাসের শুরুর দিকে মস্কো সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাশিয়াকে ভারতের ‘বিশ্বাসযোগ্য মিত্র’ এবং ‘সব পরিস্থিতির বন্ধু’ বলে অভিহিত করেছিলেন। দুই দেশের মধ্যে দশকের পর দশক ধরে চলমান কৌশলগত সহযোগিতার কথা তুলে ধরেছিলেন তিনি।
কিন্তু, মাত্র তিন মাস পরেই সেই সম্পর্কের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে কিয়েভের হাতে ভারতীয় গোলাবারুদ পৌঁছানোর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইতালি ও চেক প্রজাতন্ত্রের কেনা ভারতীয় গোলা ইউক্রেনে পাঠানো হয়েছে। গত কয়েক মাসে ইউক্রেনীয় বাহিনীর যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতীয় গোলাবারুদ ব্যবহারের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরই এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
অন্যদিকে, নরেন্দ্র মোদি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছেন। প্রথমে জুন মাসে টোকিওতে, তারপর আগস্টে প্রথমবারের মতো কিয়েভে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফর এবং সর্বশেষে গত সপ্তাহে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় নিউ ইয়র্কে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জেসওয়াল ইউক্রেনে ভারতীয় গোলাবারুদ ব্যবহারের খবরকে ‘অপপ্রচার ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি এই বিষয়ে কোনও নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে ইউক্রেনের সামরিক সরঞ্জামে ভারতীয় গোলাবারুদের উপস্থিতির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও মন্তব্য করেননি।
কিন্তু রুশ কর্মকর্তারা ভারতের এই প্রতিক্রিয়ায় সন্তুষ্ট নন। তারা প্রশ্ন তুলেছেন: ভারত কি তার গোলাবারুদের ক্রেতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে, যাতে তা ইউক্রেনে পৌঁছাতে না পারে?
একজন রুশ কর্মকর্তা আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘ইউক্রেনীয় বাহিনীর হাতে ভারতীয় গোলা ব্যবহারের যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এমনকি এ বিষয়ে ছবিও পাওয়া গেছে।’ তিনি বলছেন, সব সামরিক রফতানির ক্ষেত্রে বিক্রেতাদের তাদের অস্ত্রের চূড়ান্ত ব্যবহারকারীদের ট্র্যাক করার শর্ত থাকে। আপনারা যদি প্রমাণ দিতে পারেন যে ইতালি বা চেক প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে ভারত এই বিষয়ে যোগাযোগ করেছে, তাহলে আমরা বিশ্বাস করব।
যদি ভারতীয় গোলাবারুদ ইউক্রেনে পৌঁছায়। তাহলে বর্তমানে চলমান যুদ্ধগুলোতে ভারতীয় অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। জুন মাসে, আল জাজিরা প্রকাশ করেছিল যে, ভারতীয় কোম্পানিগুলোর তৈরি রকেট ও বিস্ফোরক ইসরায়েলে পাঠানো হয়েছিল। গাজায় চলমান সংঘাতে ৪১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।
ভারত সরাসরি না চাইলেও তৃতীয় দেশের মাধ্যমে গোলাবারুদ ইউক্রেনে পৌঁছাতে পারে—এমন ঘটনাও নজিরবিহীন নয়। নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক ওয়াহেগুরু পাল সিংহ সিধু বলছেন, ‘ব্রিটিশ কোম্পানির কাছে মেরামতের জন্য পাঠানো অবসরপ্রাপ্ত সেঞ্চুরিয়ন ট্যাংকগুলো ১৯৮০-এর দশকে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছে গিয়েছিল। যা বর্ণবাদী শাসনামলে ব্যবহার করা হয়েছিল।’
ভারত হয়তো ভেবেছে যে, ইউক্রেনের কাছে ভারতীয় গোলাবারুদ পৌঁছালেও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের তেমন ক্ষতি হবে না। এর স্পষ্ট কারণ রয়েছে। ভারত গত দুই দশকে তার অস্ত্রের দুই-তৃতীয়াংশই রাশিয়া থেকে কিনেছে। যদিও মোদি সরকার রাশিয়ার সামরিক নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে।
ইউক্রেনের যুদ্ধে সরঞ্জামে ভারতীয় গোলাবারুদের অংশ খুবই সামান্য—মোট সরবরাহের মাত্র ১ শতাংশ বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে, নিউ ইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ক্লারি বলছেন, ‘ইউক্রেনে পৌঁছানো ভারতীয় গোলাবারুদের পরিমাণ খুব বেশি না। ফলে এই ঘটনায় কূটনৈতিক উত্তেজনা খুব বেশি হবে না।’
তবে আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এক রুশ কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, কিয়েভ থেকে ফেরার পর মোদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক সম্পর্কে আপডেট দিয়েছিলেন। কিন্তু পুতিনকে কোনও কল দেননি। পুতিনই মোদিকে কল দিয়েছিলেন, যা সম্পর্কের টানাপোড়েনের ইঙ্গিত দেয়।
ভারতের কংগ্রেস দলের নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের চাপে রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য মোদিকে অভিযুক্ত করেছেন। কংগ্রেস নেতা রশিদ আলভি আল জাজিরাকে বলেছেন, মার্কিন চাপে পড়েই প্রধানমন্ত্রী মোদি বুলেটপ্রুফ ট্রেনে কিয়েভে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
সূত্র: আল জাজিরা