ডেমরায় পরপর ভূমিকম্প: দুর্বল অবকাঠামোয় বেড়েছে ঝুঁকির শঙ্কা ।। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও দুর্বল ভবন কাঠামোই বাড়াচ্ছে ঝুঁকি
Ekattor News: November 24, 2025
মো.আসাদুল্রাহ, ডেমরা, ঢাকা
রাজধানীর ডেমরায় দুই দিনের ব্যবধানে অনুভূত একাধিক ভূমিকম্প এলাকাটির নিরাপত্তা ঝুঁকি আবারও সামনে এনে দিয়েছে। এসব কম্পন দেখিয়েছে, ঘনবসতিপূর্ণ ও অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে সামান্য ভূমিকম্পও বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। এলাকার নরম সেডিমেন্টে গঠিত ভেজা মাটি কম্পনের অভিঘাতকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এর ফলে মাঝারি কম্পনে ভবনের দেয়ালে ফাটল, ভবন হেলে পড়া অথবা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঝুঁকি তৈরি হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ডেমরার মতো দুর্বল অবকাঠামোর এলাকায় বড় ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি অনিবার্য।
শনিবার (২২ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিটে রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৭ মাত্রার কম্পন অনুভূত হলেও তার আগের দিন ২১ নভেম্বর সকাল ১০টা ৩৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পটি ডেমরায় তীব্রভাবে অনুভূত হয়। পৃথিবীর ভূত্বকের নিচে টেকটোনিক প্লেটের হঠাৎ নড়াচড়া বা ফাটলের কারণেই এ ধরনের ভূমিকম্প ঘটে, যেখানে জমে থাকা চাপ ফাটলের মাধ্যমে শক্তি আকারে বেরিয়ে এসে ভূ-পৃষ্ঠে কম্পন সৃষ্টি করে। রিখটার স্কেলে ৪–৬ মাত্রার কম্পন সাধারণত মাঝারি ভূমিকম্প হিসেবে বিবেচিত হয়। সঠিক নকশা ও নির্মাণমান মেনে ভবন তৈরি করা হলে বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ডেমরার বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাজউকের অনুমতি ছাড়া নির্মিত হয়েছে অসংখ্য ভবন। পুরোনো একতলা–দোতলা ভবনের ওপর অতিরিক্ত তলা যোগ করে উঁচু করা হয়েছে। বহু ভবনে পাইলিং ও মৌলিক কাঠামোগত নিরাপত্তা মানা হয়নি, ফলে মাঝারি কম্পনও বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করে। তাছাড়া আবাসিক এলাকার গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইনের নিরাপদ নকশা ও আধুনিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার না থাকায় ভূমিকম্পের সময় গ্যাস লাইন ফেটে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাবনা তৈরি হয়। এসব কারণ মিলিয়ে ডেমরা ভূমিকম্পে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
ভূতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশ বেঙ্গল বেসিনে অবস্থিত। ভারতীয়, ইউরেশীয় ও বার্মিজ প্লেটের সংঘর্ষস্থল হওয়ায় দেশের বিভিন্ন ফল্টলাইনে দীর্ঘদিন ধরে চাপ সঞ্চিত হচ্ছে। ডাউকি ফল্ট, মধুপুর ফল্টসহ সক্রিয় ফল্টগুলোতে বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা নিয়েও বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার কাছে অবস্থিত মধুপুর ফল্ট রাজধানীর জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করে। ডেমরার মাটিও ভূমিকম্পের সময় বেশি কম্পন অনুভূত হওয়ার প্রধান কারণগুলোর একটি। নরম পলি ও সেডিমেন্টে গঠিত ভেজা মাটি লিকুইফ্যাকশনের ঝুঁকি বাড়ায়, যার প্রভাব ডেমরার মতো দ্রুত নগরায়িত এলাকায় আরও বেশি। অপরিকল্পিত নির্মাণ, নিয়ন্ত্রণহীন জমির ব্যবহার এবং অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন মাটির স্থায়িত্ব আরও কমিয়ে দিচ্ছে।
এই অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেমরায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে জরুরি ভিত্তিতে রেট্রোফিটিং করা এখন সময়ের দাবি। রেট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে দুর্বল ভবনকে ভূমিকম্প-সহনীয় করা সম্ভব, যা বড় ধরনের ক্ষতি কমাতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি স্কুল, কলেজ, মসজিদ ও কমিউনিটি সেন্টারে নিয়মিত ভূমিকম্প প্রস্তুতি প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক সতর্কতা ব্যবস্থা চালুরও তাগিদ দিচ্ছেন তারা।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রহমান বলেন, হঠাৎ পুরো ঘরটা এমনভাবে কেঁপে উঠল যে প্রথমে বুঝতেই পারছিলাম না কী হচ্ছে। আমার ৩৭ বছরের জীবনে এত শক্ত ভূমিকম্প কখনো অনুভব করিনি। ভয়ে বাড়ির বাইরে ছুটে আসতে বাধ্য হই। আরেক বাসিন্দা ফরিদা ইয়াসমিন জানান, আমি ছয়তলায় থাকি। ভূমিকম্প শুরু হতেই পুরো বিল্ডিং দুলতে থাকে। নিচে নামার সুযোগ ছিল না। ভয়ে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদছিলাম আর ভাবছিলাম আমরা বাঁচব কি না। একইভাবে বাসিন্দা মো. মহিউদ্দিন বলেন, ভূমিকম্পের সময় আমার বাড়িটা কাঁপতে থাকে। সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে এই বাড়ি করেছি, কিছু হয়ে গেলে সব শেষ হয়ে যেত। সেই মুহূর্তে কয়েক সেকেন্ডের কম্পনেই যেন সবকিছু হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছিলো।
ইতিবাচক দিক হলো, সাম্প্রতিক কম্পনের পর ডেমরায় বড় কোনো কাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি দেখা যায়নি। কয়েকটি ভবনে দেয়ালে ফাটল ও একটি ভবন সামান্য হেলে পড়লেও পরিস্থিতি গুরুতর হয়নি। এলাকায় আগে থেকেই হেলে থাকা ভবনগুলোতেও নতুন কোনো ক্ষতি দেখা যায়নি। দোকানপাটের কিছু মালামাল ভেঙে ক্ষতি হয়েছে, তবে কোনো আহত বা নিহতের ঘটনা ঘটেনি।
এ বিষয়টি নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) অঞ্চল-৮–এর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহেব হোসেন বলেন, ওয়ার্ডভিত্তিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার জন্য রাজউক ও ডিএসসির পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বিত নির্দেশনায় মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করা হবে। এলাকায় যেসব ভবন অনুমোদনহীন, অপরিকল্পিত বা কাঠামোগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, সেগুলো শনাক্ত করে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হচ্ছে। তিনি জানান, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি জোরদার করার পাশাপাশি ভবন নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রমও চালানো হবে।
ডেমরা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মাহমুদুর রহমান বলেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো এখন অত্যন্ত জরুরি। বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হঠাৎ করেই আসতে পারে, তাই আগেই প্রস্তুতি গ্রহণ করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ডেমরা এলাকায় বাসিন্দাদের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছি, কীভাবে ভূমিকম্পের সময় নিরাপদে থাকতে হয়, কী করণীয় ও বর্জনীয়, এবং কীভাবে পরিবারকে প্রস্তুত রাখতে হয়, এসব বিষয়ে সবাইকে জানানো হচ্ছে। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে শুধু উদ্ধার ব্যবস্থার উপর নির্ভর করলে হবে না, বরং ভূমিকম্পের আগেই মানসিক ও বাস্তব প্রস্তুতি নেওয়াই পারে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্প ঠেকানো সম্ভব নয় কিন্তু ক্ষতি কমানো সম্ভব। তাই ডেমরার জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি হলো পরিকল্পিত পদক্ষেপ, অবকাঠামোগত শক্তিবৃদ্ধি এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি। অবহেলা নয়, বাস্তবসম্মত প্রস্তুতিই পারে বড় বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে।
প্রধান সম্পাদক : মো রফিকুল ইসলাম ।
নির্বাহী সম্পাদক : মো খলিলুর রহমান।
যুগ্ম বার্তা সম্পাদক : মো মনসুর আহমেদ।
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : মো শরিফ ভূইয়া।
অফিস: মোতালেব ম্যনশন, ২ আর কে মিশন রোড, ঢাকা।
ই-মেইল: ekattornews98@gmail.com
